প্রত্যেকটি নতুনত্বের কিছু গূঢ় অর্থ ও ভবিষ্যৎ সুবিধা প্রাপ্তির বিষয় থাকে। প্রচুর গবেষণা কিংবা গতানুগতিক পরিবর্তনের জন্যই মূলত আমরা নতুন পথে ধাবিত হয়ে থাকি।
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার পিপাসায় কাতরতাই একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে পৌঁছে দেয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আঙ্গিনায়। ভর্তি যুদ্ধের লড়াইয়ে অংশ নিয়ে সফলতার মূখ দেখে আলোকিত মনে হয় সব কিছুই। কিন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতে মনে হয় জ্ঞানের রাজ্যে স্বপ্নীল হৃদয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক উর্বর ভূমি। শিক্ষার্থীদের ধারণা থাকে অনেক পড়াশোনা হবে, ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা আলোকিত মানুষ হয়ে দিকভ্রান্ত সমাজকে সে তমাশার ঘোর অমানিশা থেকে মুক্ত করবে। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র এমন প্রত্যাশাই করবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে এই রাষ্ট্র যে ব্যয় করছে তার ফিডব্যাক স্বরুপ অনেক আশা ও প্রত্যাশা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। পন্ডিত নেহেরু বলেছিলেন, ”দেশ ভালো হয়, যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলি ভালো হয়”।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২৮ মে ২০০৭ সালে। এক যুগ পেরিয়ে আজ প্রায় দেড় যুগের দ্বারপ্রান্তে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র হলেও এসব নামমাত্র। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক-ছাত্রদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাক্ষী হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে সংঘর্ষে নিহত হয় মার্কেটিং ৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ।বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ বঙ্গবন্ধু পরিষদ নামে দুটি সংগঠন পরিচালনা করছেন।
বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপের শিক্ষকদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার সঞ্চার করে। সোস্যাল মিডিয়াতে কুবিকে নিয়ে নেচিবাচক সংবাদ যেনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের ভূমি বাণিজ্য, ছাত্রদের টেন্ডারবাজী, হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের উপর বিনাকারণে মারধর এসবে নিজকে মর্মাহত হতে হয় প্রায়শই। বিরোধী মতকে সহ্য করতে না পেরে বিভিন্ন ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের অবতারণা হয়েছে এই প্রাঙ্গণে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের IQAC নিয়ম-কানুন কতটুকু বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রাখছে তা বলা মুশকিল।আমার এখানে একটা প্রশ্ন হচ্ছে যে শিক্ষররা যদি ভালো ক্লাস না নেয়, ক্লাসে ভালো ভালো তথ্য না দেয় তাহলে শিক্ষার্থীরা কিভাবে এত ভালো ভালো তথ্য লিখতে পারবে পরীক্ষায়? শিক্ষকরা ক্লাসে কম তথ্য দিয়ে আমাদের কোনো মতো টপিক বুঝিয়ে দিয়ে ক্লাস শেষ করে দেয় এতে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি হলেও সৃজনশীলতার শক্তি মানে সেই টপিক নিয়ে গবেষণা করার মতো জ্ঞান আমাদের তৈরি হয় না। আর গবেষণা করা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির সাথে বিশেষভাবে জড়িত । কিন্তু গবেষণা তো দূরে থাক অনেক সময় দেখা যায় পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তরই ঠিক মতো দেয়া যায় না। কারণ শিক্ষকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় নিয়মিত ক্লাস, প্রেজেন্টেশন ও গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারছেন না। নামমাত্র কিছু ক্লাস নিয়েই জটিল বিষয় কোর্স সমাপ্ত করছেন, ভুক্তভোগী হচ্ছেন বহুল প্রত্যাশা নিয়ে উচ্চ শিক্ষার গন্ডিতে আসা জ্ঞানপিপাসুরা।
বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা তথা ব্যক্তিগত জীবন একটি বড় আবেগের জায়গাজুড়ে থাকে। হাজার জল্পনা-কল্পনায় সাজানো সে স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে যাত্রা শুরু করলেও বেশির ভাগ স্বপ্ন কিন্তু অসমাপ্ত থেকে যায়। একটু ঐতিহ্যবাহী অর্জনের ধারা খুঁজতে গেলে আমাদের যুদ্ধপূর্ব তথা ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান , ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী নব্বইয়ের দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং আরও কিছু অর্জনের কথা সম্মুখে চলে আসে। অথচ এর পর থেকে চিন্তাবিদ কিংবা হাতেগোনা দু-চারজন বুদ্ধিজীবী ছাড়া কেউ ভাবনা-চিন্তা, বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্র কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না।
প্রাপ্তিতে ঢেকুর তোলা সহজ কিন্ত যদি গুরুজনেরা একটু চিন্তা করেন, কী দিয়েছেন? কতটুকু জ্ঞান দেওয়ার সক্ষমতা ছিল আপনার। বর্তমান সময় প্রতিযোগিতার বাজারে শিক্ষার্থীদের মূলধন কতটুকু। তা বিনিয়োগ করে সে কি প্রত্যাশা করতে পারে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী হতাশার গ্লানিতে আত্নহত্যা পর্যন্ত করেছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করলেই নিজেকে মহাজ্ঞানী ভাবার সুযোগ নেই কারণ এই সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে তো শিক্ষার্থীদের দ্বায়বন্ধতার বোধটুকু তৈরি হওয়া প্রয়োজন। রিক্সাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, কুলি-মজুর সকল শ্রেণি পেশার মানুষের টেক্সের অর্থায়ন রয়েছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয়ভার হিসেবে ভর্তুকি প্রদানে।
শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে শিক্ষার মান নির্ণয় করা যায় না। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এগিয়ে চলছে বিশ্ব, পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও।
১৭ বছর পূর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে প্রত্যাশা: প্রাণের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাক দুর্নিবার গতিতে, ধূয়ে মুছে যাক অতীতের সব অপরাজনীতি। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধো হউক। সম্মুখে এগিয়ে যাক শিক্ষা, গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র। শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের জন্য বজায় থাকুক শিক্ষা বান্ধব পরিবেশ।কলহ দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের গবেষণার মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি হউক কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
লেখক- অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ অফিসার, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সাবেক শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ (ষষ্ঠ ব্যাচ), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।