ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০২২ সালের এপ্রিলে শ্রীলংকা ছেড়ে পালিয়ে যান মাহিন্দা রাজাপাকসে। সরকারের আকস্মিক পতনে ভেঙে পড়ে দেশটির রাষ্ট্র ব্যবস্থা। দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলংকার অর্থনীতিতে তখন নজিরবিহীন দুর্দশা। সরকারবিহীন পরিবেশে ভেঙে পড়ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ঠিক এমন মুহূর্তে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকার (সিবিএসএল) গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিংহে এক বিবৃতিতে বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকার গঠন না হলে কারো পক্ষেই শ্রীলংকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হবেন। অর্থনীতির ভগ্নদশা থেকে পুনরুত্থানের জন্য গোটা শ্রীলংকা তখন তার দিকেই তাকিয়ে। তার এমন হুমকিতে নড়েচড়ে বসে দেশটির রাজনীতিবিদসহ সবাই। দ্রুত গঠন করা হয় সরকার। কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়নসহ শ্রীলংকার অর্থনীতিকে উন্নতির গতিপথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন নন্দলাল বীরাসিংহে।
শ্রীলংকার দুর্দশার সময় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর শক্ত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হলেও বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে অফিসে যাচ্ছেন না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি এখন কোথায়, তা-ও কেউ জানে না। দেশের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। উল্টো এ মুহূর্তে নেতৃত্বশূন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই এখন অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা চার ডেপুটি গভর্নরসহ ছয় শীর্ষ কর্মকর্তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন গতকাল। অবরুদ্ধ অবস্থায় জ্যেষ্ঠ ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরও করিয়ে নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিজ নিজ কার্যালয় ছেড়ে গেছেন অন্য ডেপুটি গভর্নররা। একই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাসের ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকেও নিজ নিজ কার্যালয় থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গতকাল সকালে তিন শতাধিক কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। তাদের পদত্যাগ ও বিচারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন, পে স্কেল, সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধসহ বিভিন্ন দাবি জানান বিক্ষোভকারী কর্মকর্তারা। পরে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে পদচ্যুত স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত চুক্তিভিত্তিক ছয় শীর্ষ কর্মকর্তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়। এরই মধ্যে চার ডেপুটি গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের স্বার্থে ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার দায়িত্ব পালন করবেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর তিনিও পদত্যাগ করবেন।’
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার রাতের আঁধারে দেশত্যাগ করেছেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সব নির্বাহী পরিচালকের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক শেষে মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যে পদত্যাগের দাবি করেছেন, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ সরকারের পক্ষ থেকেই তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
যে ডেপুটি গভর্নররা পদত্যাগ করেছেন, তাদের কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে এ মুখপাত্র বলেন, ‘তারা পদত্যাগপত্র কার কাছে দিয়েছেন, তাদের নিয়োগ দিয়েছে সরকার; পদত্যাগপত্র দিতে হলে সরকারের কাছেই দিতে হবে। অন্য কারো কাছে তারা পদত্যাগপত্র দিতে পারেন না। গভর্নর ছুটিতে আছেন; এখন ডেপুটি গভর্নররা দায়িত্ব পালন করে যাবেন।’
এদিকে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হট্টগোলের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশের ব্যাংক খাতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, সরকার পতনের পর দেশে এখনো নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়নি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। এ পরিস্থিতিতে দেশের লেনদেন ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে গোটা অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পেশাদারত্ব বজায় রাখা দরকার।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে যে পরিস্থিতি হয়েছে, সেটি আমরা শ্রীলংকার সরকার পতনের পর দেখিনি। এমনকি তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে শুনিনি। অনিয়মের প্রতিবাদ করে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের উঁচু, নিচু কিংবা মাঝারি স্তরের কোনো কর্মকর্তা পদত্যাগ করার ঘটনাও ঘটেনি। তাহলে হঠাৎ তারা শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠলেন কেন? যেখানে গোটা বাংলাদেশ ব্যাংকই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান!’
গত সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার অফিসে আসছেন না। জ্যেষ্ঠ ডেপুটি গভর্নর হিসেবে কাজী ছাইদুর রহমান ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকশ কর্মকর্তা-কর্মচারী হইচই ও স্লোগান দিতে দিতে কাজী ছাইদুর রহমানের রুমে যান। এ সময় সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কর্মকর্তারা গভর্নর-ডেপুটি গভর্নরদের ব্যাংক খাত লুটের সহযোগী ও দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করেন। কয়েকজন কর্মকর্তা ছাইদুর রহমানকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করতেও উদ্যত হন। পরে তার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেন তারা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে অন্তত তিনজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কাজী ছাইদুর রহমান শুধু অনিয়ম-দুর্নীতির সহযোগীই ছিলেন না, বরং তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বহু কর্মকর্তাকে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কারণে হয়রানি করেছেন। তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। এ কারণে তার ওপরই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশি ক্ষুব্ধ।’
কাজী ছাইদুর রহমান পদত্যাগপত্র লিখে দিলে বিক্ষুব্ধরা ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহারের কক্ষে যান। তখন ফোনে যোগাযোগ করলে নুরুন নাহার জানান, তিনি কার্যালয় ত্যাগ করছেন। বাকি দুই ডেপুটি গভর্নর মো. খুরশীদ আলম ও মো. হাবিবুর রহমান কার্যালয়ে ছিলেন না। কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তারা জানান, তারা আর অফিসে আসবেন না। একইভাবে নীতি উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাসের ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাসুদ বিশ্বাস নিজ নিজ কার্যালয় থেকে বের হয়ে চলে যান।
পদত্যাগের বিষয়ে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে তিন ডেপুটি গভর্নরসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলা হয়। তারা জানান, পরিস্থিতির কারণে তারা অফিস থেকে চলে এসেছেন। নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর যে সিদ্ধান্ত আসবে, সেটি তারা মেনে নেবেন।
কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেয়া শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থের জন্য তারা দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাত ও অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থায় চিড়ও ধরিয়েছেন। স্বৈরাচার সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ সব কর্মকর্তাসহ নিয়মিত কর্মকর্তাদের আর্থিক অনিয়মের তদন্ত শুরু করা দরকার। বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান ও স্বাভাবিক থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়।