“বঙ্গবন্ধু” শব্দ টা শুনলেই কেমন যেন আপন আপন মনে হয়, যেন নিজের খুব কাছের কেউ। এটি শুধুমাত্র শব্দ ই নয় এটি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা একটি আবেগের নাম। হ্যা, আমি মজলুমের বন্ধু এবং অন্যায়-অবিচারকারীদের জম, বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর কথা ই বলছি।
১৯২০ সালের ৭ ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্ম নিয়েছিল মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছোটবেলায় তার ডাকনাম ছিল ‘খোকা’।খোকা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন জণগণের বন্ধু এবং একজন আদর্শ ছাত্র। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদী মনোভাবের।গত শতকের ত্রিশের দশকের মধ্যেই স্বদেশি আন্দোলন দেখে ইংরেজবিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে বালক শেখ মুজিবের মনে।তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন- “লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। …ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।”
পরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ বিভাজনে মুসলিম লীগের প্রতি ঝুঁকে পড়েন শেখ মুজিব। সারা জীবন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির ভক্ত ছিলেন।
মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। – নোবেল জয়ী উইলি ব্রানডিট
কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় থেকেই শেখ মুজিব সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে এবং এ সময়েই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হয়েছিলেন।১৯৪৬এর প্রাদেশিক নির্বাচনে শেখ মুজিব মুসলিম লীগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। তিনি পাকিস্তানে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বেঙ্গল মুসলিম লীগের হয়ে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নেন ১৯৪৬য়ে। ৪৬য়ে কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর শেখ মুজিব শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন এবং তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্ত হন তিনি। সেখান থেকেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের নতুন অধ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন বঙ্গবন্ধু, এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।
জীবদ্দশায় তিনি সহ্য করেছেন হাজারো কষ্ট কারাবরণ করেছেন অনেকবার।এরপরেও মজলুম দের পাশ থেকে সরে দাড়াই নি । বাঙালির প্রত্যেকটি অধিকার আদায়ের আন্দোলনে (৫৪’র যুক্তফ্রন্ট, ৫৮’র সামরিক শাসন,৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’র এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির।বাচন)তার ভূমিকা ছিল বিরল।তিনিই ছিলেন বাঙ্গালির স্বাধীনতার স্হপতি এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।স্বধীনতা পরবর্তী সময়েও তিনি অক্লান্ত কাজ করে গেছেন দেশের উন্নয়নের জন্য। এ মহান নেতা অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট ঘাতকদের হাতে সপরিবারে শহীদ হন। রচিত হয় ইতিহাসের এক অন্যতম কালো অধ্যায়। এ কারণেই ১৫ই আগস্ট দিন টি পালিত হয় জাতীয় শোক দিবস হিসাবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।
এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।
একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
এই দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বিশেষ মুনাজাত ও কোরআন তিলাওয়াত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সকালে ধানমন্ডিতে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর বনানীতে ১৫ আগস্ট নিহত শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানানো হয়। টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। এ সময় ফাতিহা পাঠ ও সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদানসহ বিশেষ মুনাজাত ও দোয়া মাহফিল হয়। বাদ জোহর সারা দেশে মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ মুনাজাত ও প্রার্থনা করা হয়। বেতার ও টেলিভিশন শোক দিবসের অনুষ্ঠানমালা সরাসরি সম্প্রচার করে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সারাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।