জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় চট্টগ্রামে হামলা, হামলার পরিকল্পনা ও হামলার নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ এনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ১৮৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
মহানগরের নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা কফিল উদ্দিন গত সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে মামলাটি করেন। আদালত বাদীর বক্তব্য শুনে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এই মামলার পরপরই শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা-সমালোচনা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মামলার বাদীর বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় অস্ত্র ও মাদকসহ তিনটি মামলা এবং আনোয়ারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে। গ্রেপ্তার হয়ে একাধিকবার কারাগারেও গেছেন তিনি।
মামলাটির আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক সংসদ সদস্য এম এ মোতালেব, মজিবুর রহমান, জাতীয় পার্টির চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি সোলায়মান আলম শেখ, পিবিআই সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার, ডিবি সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম, চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল হক।
মোট ২৬ পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও আসামি করা হয়েছে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম, সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ, ওয়াসিম উদ্দিন ও মোবারক আলীকে।
তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে এক যুবককে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণে আহত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। সূত্র অনুসারে, বাদী কফিল উদ্দিন নিজেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত।
এজাহার অনুসারে, কফিল মহানগরের নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা। গত ৪ আগস্ট নিউ মার্কেট গোলচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ওই দিন আসামিদের কয়েকজনের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় বাকি আসামিরা গুলি করেন এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। এতে বাদী হাতে আঘাত পান। আহত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
সুস্থ হয়ে সংশ্লিষ্টদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করতে দেরি হওয়ায় মামলা করতেও তার দেরি হয়, এজাহারে উল্লেখ করেন কফিল।
পুলিশ সূত্রমতে, মামলায় আসামি হওয়া চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ মহসিন ঘটনার দিন ছিলেন ঢাকার তেজগাঁও থানায় কর্মরত। আরেক সাবেক ওসি নেজাম উদ্দিন বদলিজনিত কারণে অন্যত্র ছিলেন। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে দায়িত্বরত ছিলেন পাঁচলাইশ থানার সাবেক ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা, চান্দগাও থানা এলাকায় ছিলেন তৎকালীন ওসি জাহিদুল কবির। খুলশী থানা, চান্দগাও থানা ও বাকলিয়া থানার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়েছে যারা ঘটনার দিন অন্য এলাকায় কর্মরত ছিলেন।
এজাহার অনুসারে, কফিল বেসরকারি চাকরি করেন। তার বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়ন এলাকায়। তার বাবা মৃত জেবেল হোসেন। মায়ের নাম শাহাজাহান বেগম। কোতয়ালী থানার নন্দনকানন এলাকার দুই নম্বর গলিতে তিনি বর্তমানে বসবাস করেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কফিল যুবলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং নিজেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের ‘বিতর্কিত’ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী পরিচয় দিতেন। বাবরের বাসাও চট্টগ্রামের নন্দনকানন এলাকায়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাবর আত্মগোপনে আছেন। গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের সংঘর্ষে তিনজন প্রাণ হারান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে সেদিন অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের নেতৃত্ব দেন বাবর। ৪ আগস্ট নিউ মার্কেট এলাকায় বাবরের অনেক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিলেন। বাবরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও, কফিল তার মামলায় বাবরের নাম উল্লেখ করেননি।
কফিল উদ্দিনের পক্ষে আদালতে মামলাটি দায়ের করেছেন চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। কফিল উদ্দিনের সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের যা তথ্য আমরা তা আদালতে দিয়েছি। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাদীর বিরুদ্ধে আগে কোনো মামলা আছে কি না আমি জানি না।’
আনোয়ারার বারখাইন এলাকার ছয় নম্বর ইউনিয়নের সদস্য মোহাম্মদ রাশেদুল বশর বলেন, ‘কফিল বাড়িতে আসেন না। তার ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়।’
কফিলের বড় ভাই মো. জমির বলেন, ‘আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, আমি তার সম্পর্কে জানি না। সে শহরে থাকে, কী করে আমরা জানি না। শুনেছি খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেশে। মানা করেছিলাম, উল্টো আমার সঙ্গে লাগতে আসে।’
এজাহারের তথ্য অনুসারে, আন্দোলনের সময় কফিল নিউ মার্কেট এলাকার গোল চত্বরে আহত হয়েছিলেন।
কফিল বলেন, ‘তিনি নগরীর তিন পোলের মাথা-রাইফেলস ক্লাব এলাকায় ছিলেন। সেখানে তাকে পেটানো হয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়।’
যুবলীগ-ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন স্বীকার করে কফিল বলেন, ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগ করা অন্যায় কিছু না। সমন্বয়কদের অনেকে ছাত্রলীগ করেছেন। ‘বিবেকের তাড়নায় আন্দোলনে ছিলাম। সরকার দলীয় রাজনীতি করলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছিলাম, কারণ রাজনীতিতে আমি বৈষম্যর শিকার, আমার পদ-পদবি ছিল না। এটা সত্যি আমি বাবর ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতিতে ছিলাম।’
বাবরকে আসামি না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবর ভাই এবং অনান্যদের দেখিনি সেখানে, তাই আসামি করা হয়নি।’ তার বিরুদ্ধে দায়ের মামলাগুলো রাজনৈতিক দাবি করে কফিল বলেন, ‘পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে মামলা দিছে শুধু শুধু। এগুলো বিচারাধীন। এগুলোর সত্যতা নেই।’
তবে মামলা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমরা আগেও বলেছি কেউ যাতে মিথ্যা মামলা দিয়ে বাণিজ্য করতে না পারে। ভুয়া মামলার কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাও বিচার পাবেন না। আমরা এটি নিয়ে আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে কথা বলব।’
চট্টগ্রামে মঙ্গলবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, আগে ভুয়া মামলা করত পুলিশ। এখন করছে পাবলিক (জনগণ)।
এদিকে কফিলের বিরুদ্ধেও ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগ রয়েছে। গত ১০ নভেম্বর কোতয়ালী থানায় ২৭৮ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন মো. রাইয়ান নামে এক ছাত্র। সেখানে কফিলকে ২৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল।
এজাহারে রাইয়ান অভিযোগ করেন, আসামিরা পরস্পরের সহযোগিতায় গত ৪ আগস্ট নিউ মার্কেট এলাকায় মিউনিসিপাল স্কুলের সামনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেন এবং গুলি চালান। এতে রাইয়ানের চোখে ও হাতে-পায়ে গুলি লাগে। মামলায় ১০০ থেকে ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে৷
পুলিশ বলছে, আসামি কফিল পলাতক। এদিকে কফিলও তার দায়ের করা মামলায় রাইয়ানকে ৯২ নম্বর আসামি করেছেন।