রওশন এরশাদ, সাদ এরশাদ ও ডা. কেআর ইসলামকে মনোনয়ন দিতে রাজি আছেন জিএম কাদের। অন্যদিকে মসিউর রহমান রাঙ্গা, গোলাম মসীহ, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, কাজী মামুনুর রশীদ, জিয়াউল হক মৃধা, এসএম ফখরউজ্জামান জাহাঙ্গীর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলনসহ ১২ জনের মনোনয়ন নিশ্চিত করার দাবি রওশন এরশাদের।
এসব নেতারা অনেকদিন ধরেই রওশন এরশাদের সঙ্গে রয়েছেন। রওশন এরশাদ ঘোষিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব নেতার কারোরই জাতীয় পার্টিতে পদ-পদবি নেই। আগে থাকলেও কেউ স্বেচ্ছায় নিস্কিয় হন, আবার কাউকে কাউকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
পাশাপাশি রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদের রংপুর-৩ আসন নিয়েও দেবর-ভাবি (জিএম কাদের-রওশন এরশাদ) একমত হতে পারছেন না। ওই আসনে বর্তমান এমপি সাদ এরশাদকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই নির্বাচনে লড়তে চান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
ছেলের আসন নিয়ে টান দেওয়ায় দূরত্ব আরও বেড়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে রংপুর-৩ (সদর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন পুত্র সাদ এরশাদ। ২০ নভেম্বর জিএম কাদের এর পক্ষে রংপুর-৩ আসনের মনোনয়ন ফরম তোলা হয়েছে। জিএম কাদের বিগত কয়েকটি সংসদে লালমনিরহাট সদর থেকে নির্বাচন করে আসছেন।
দেবরের এমন আচরণে বেজায় চটেছেন রওশন এরশাদ। প্রয়োজন হলে নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে চান তবুও অনুসারীদের ছেড়ে নির্বাচনে যেতে নারাজ তিনি। সরকার প্রধানকে জানিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে চান। সাক্ষাতের জন্য সময় চেয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র বার্তা২৪.কমকে বলেছেন।
তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগেও রওশনের অবস্থান ছিল ভিন্ন। তার অনুসারীরা ভিন্নভাবে মনোনয়ন ফরম বিক্রির পরামর্শ দিলেও তাতে সায় দেন নি। তখন বলেছিলেন, সবাইকে নিয়ে পার্টি করতে হবে, পার্টিকে ভাগ করা উচিত হবে না।
গত ২০ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিকট দলীয় ফরম বিতরণ করে জাতীয় পার্টি। মনোনয়ন ফরম বিতরণ শেষ হলেও রওশন এরশাদ কিংবা তার সন্তান সাদ এরশাদসহ অনুসারীরা কেউই পার্টির মনোনয়ন ফরম তোলেন নি। অবশ্য আগেই রওশন অনুসারীদের মনোনয়ন ফরম না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে রাখেন জিএম কাদের।
শনিবার (২৫ নভেম্বর) জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের জানান, আমাদের সম্মানিত প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ গতকালও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করেছিলেন। তিনি তার ও পুত্র সাদ এরশাদ এবং ডাঃ কে আর ইসলামের জন্য তিনটি মনোনয়ন ফরম চেয়েছেন। বেগম রওশন এরশাদ বললে, আমরা তাঁর মনোনয়ন ফরম পাঠিয়ে দেবো। প্রয়োজন হলে আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দেবো। তার জন্য সময় কোনো বিষয় না। যখন চাবেন তখনই দেওয়া হবে। পার্টির মহাসচিব কয়েকদিন ধরেই এমন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
২৫ নভেম্বর রাতে রওশন এরশাদের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন জিএম কাদের। ওই বৈঠকের পর অনেকেই আশা করেছিলেন দেবর-ভাবির ঠান্ডা লড়াই এবার শেষ হবে। খবর রটে যায় রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা রোববার (২৬ নভেম্বর) মনোনয়ন নিতে বনানী আসবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকেই দেখা যায় নি।
এদিকে পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষ হয়েছে রোববার। ২৭ নভেম্বর প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করার কথা জানিয়েছেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।
দেবর-ভাবির ঠান্ডা যুদ্ধ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই দৃশ্যমান। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় দেবর ভাবির মধ্যে। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদ জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদ পাল্টাপাল্টি চিঠি দেন স্পিকারকে। শেষ পর্যন্ত রওশনের চিঠিকে মূল্যায়ন করেন স্পিকার।
ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে ২০২২ সালে ৩১ আগস্ট হঠাৎ করেই একতরফা জাতীয় পার্টির কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন এরশাদ। ২৬ নভেম্বর পার্টির কাউন্সিলের তারিখ দিয়ে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে দেন। প্রতিক্রিয়ায় মাঠে নেমে পড়ে জিএম কাদের পন্থীরাও। একদিনের ব্যবধানে রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দিতে স্পিকারকে চিঠি দেন।
যদিও শেষ পর্যন্ত সেই চিঠির কোন কার্যকারিতা দেখা যায় নি। রওশন পন্থি বলে পরিচিত মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ কয়েকজন নেতাকেও বহিষ্কার করেন জিএম কাদের। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদ থেকেও মসিউর রহমান রাঙ্গাকেও সরাতে চিঠি দেন জিএম কাদের। এবারও আটকে দেন রওশন এরশাদ।
রওশন ঘোষিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব গোলাম মসিহ্ বেশ তোড়জোড় নিয়েই কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ৪৫টি জেলায় প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে। এতে জায়গা পান নানা কারণে নিষ্ক্রিয় জাতীয় পার্টির সিনিয়র ও পদবঞ্চিত নেতারা। গুলশানের ৪৭ নম্বর রোডে আলাদা অফিস নিয়ে চলে পার্টির কর্মকাণ্ড। যে অফিস এখনও বিদ্যমান।
দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানের এক সময়ে সংসদ বর্জনের আল্টিমেটাম দেন জিএম কাদের। অন্যদিকে রওশন এরশাদ এক তরফা কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই দুই পক্ষই রণে ভঙ্গ দেন। জিএম কাদের সংসদ বর্জনের হুমকি থেকে সরে আসেন। ২ মাসের মাথায় ৩০ অক্টোবর হঠাৎ করেই কাউন্সিল সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন রওশন।
দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে রওশন এরশাদ দেশে ফিরলে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে হাজির হন দেবর-ভাবি। সেই বৈঠকের পরে বরফ গলতে শুরু করে। অনেক দিন পর ১ জানুয়ারি পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন রওশন এরশাদ। এরপর কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে রওশন পন্থিরা।
কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। জিএম কাদের ছিলেন অনেকটাই নির্বাচনের বিপক্ষে, আর রওশন এরশাদ আগাগোড়া নির্বাচনমুখী। রওশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা আগেভাগেই দিয়ে রেখেছিলেন। আর ২২ নভেম্বর অনেকটা বাধ্য হয়েই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন জিএম কাদের। কথিত রয়েছে দুই পক্ষই পৃথকভাবে নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর তালিকা তৈরি করেছেন।
গত ১৮ নভেম্বর জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ পৃথক চিঠি জমা দেন ইলেকশন কমিশনে। রওশন তার চিঠিতে মহাজোট গঠন ও নৌকা অথবা লাঙল প্রতীকে নির্বাচনের কথা জানান। অন্যদিকে জিএম কাদের নিজে লাঙল প্রতীক বরাদ্দ করার জন্য স্বাক্ষরের নমুনা কপি প্রেরণ করেন।