মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ দিনে নোয়াখালী জেলায় ৬টি সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত ৬ প্রার্থী ছাড়াও জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) বিকেল ৪টা পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে জেলার ছয়টি আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন দলের ৫৫ জন প্রার্থী।
এদিন সকালে সদর উপজেলার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আখিনূর জাহান নীলার নিকট মনোনয়ন ফরম দাখিল করেন নোয়াখালী- ৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী একরামুল করিম চৌধুরী।
দুপুরে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা দেওয়ান মাহবুবুর রহমানের নিকট মনোনয়ন ফরম জমা দেন নোয়াখালী- ৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিন। এসময় জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এইচ এম খাইরুল আনম চৌধুরী সেলিমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এইচ এম খাইরুল আনম চৌধুরী সেলিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন নির্বাচন যেনো অংশগ্রহণমূলক হয়। কোনো প্রার্থী যেনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত না হতে পারেন। আমি নিজেও দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছিলাম। তবে আমাকে মনোনয়ন ফরম দেওয়া হয়নি। আমি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিনের পক্ষে মনোনয়ন ফরম দাখিল করেছি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী শিহাব উদ্দিন শাহিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আমাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য যে কেউ প্রার্থী হতে পারবে বলেও নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তারা আমাকে প্রার্থী হতে বলেছেন। তাই আমার সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচ এম খাইরুল আনম চৌধুরী সেলিমসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানবৃন্দ এসে মনোনয়ন দাখিল করেছেন।
তিনি আরও বলেন, নোয়াখালী- ৪ আসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ আসন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সভাপতি জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার আবদুল মালেক উকিল। তার মৃত্যুর পর নেতৃত্ব শূন্যতা বিরাজ করছিল। আমরা যেভাবেই হোক একজনকে এমপি নির্বাচিত করেছি। যদিও তিনি এই আসনের বাসিন্দা নন। তিনি এই এলাকার বহিরাগত। মানুষ সুখে দুঃখে তাকে পায় না। এই এলাকার জনগণের চাওয়া যেনো এই এলাকার বাসিন্দা যেনো সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়। উন্নয়নের স্বার্থে আমাকে তারা প্রার্থী করেছেন।
এরপরে নোয়াখালী- ৬ (হাতিয়া) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী মনোনয়ন ফরম দাখিল করেন। একই সঙ্গে তার স্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউসও মনোনয়ন ফরম দাখিল করেন।
মোহাম্মদ আলী বলেন, হাতিয়ার যত দাবি ছিল প্রায় সবগুলো দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূরণ করেছেন। তিনি শতভাগ বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, নদী ভাঙন রক্ষায় ৩৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছেন। এখন মূল সমস্যা হলো নৌ পারাপার। সর্বশেষ সি ট্র্যাক দেওয়া হয়েছে ২০১০ সালে। এটি সাত আট বছর পর ভালো সার্ভিস দেয় না। ফলে হাতিয়ার মানুষের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। নৌ পারাপার নিয়ে আমরা গভীরভাবে চিন্তিত। আমি জয়ী হলে হাতিয়ায় নিরাপদ নৌ যোগাযোগ করব।
জেলা প্রশাসকের নিকট মনোনয়ন ফরম দাখিল করেন নোয়াখালী- ২ (সেনবাগ-সোনাইমুড়ী) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বাফুফের সহ-সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক।
একই সময় সেনবাগ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা জিসান বিন মাজেদের নিকট মনোনয়ন ফরম দাখিল করেন নোয়াখালী- ২ (সেনবাগ-সোনাইমুড়ি) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোরশেদ আলম।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে টানা তৃতীয়বারের মতো দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। আমার হাত ধরেই এই নির্বাচনী এলাকা উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে। দেশবিরোধী কোনো দল ক্ষমতায় আসলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। একই সঙ্গে দেশ আবার সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সংসদীয় ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বিকল্প ধারা, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণফ্রন্টসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৫৫ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
নোয়াখালী- ১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ি আংশিক) আসনে মোট প্রার্থী ১১ জন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহিম মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ২ জন। এছাড়া জাসদ, গণফ্রন্ট, তরিকত ফেডারেশন, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস এছাড়া স্বতন্ত্র ১ জনসহ ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।
নোয়াখালী- ২ (সেনবাগ- সোনাইমুড়ি আংশিক) এ আসনে মোট প্রার্থী ১৩ জন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোরশেদ আলম। এ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ৪ জন ছাড়াও জাতীয় পার্টি, জাসদ, বিএনএফ, কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট, জাকের পার্টি সহ স্বতন্ত্র ২ প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।
নোয়াখালী- ৩ (বেগমগঞ্জ) আসনে মোট প্রার্থী ১১ জন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মামুনুর রশিদ কিরন। এ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ৩ জন। জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, জাকের পার্টি, জাসদ, সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট ও ২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।
নোয়াখালী- ৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনে ৯ জন মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী একরামুল করিম চৌধুরী। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী একজন। এ আসনে বিকল্পধারার প্রার্থী আবদুল মান্নান মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এছাড়া জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট ও সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের প্রার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।
নোয়াখালী-৫ (কোম্পানিগঞ্জ-কবিরহাট) এ আসনে মোট প্রার্থী ৫ জন। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে বুধবার মনোনয়ন ফরম জমা দেয়া হয়। তবে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। এছাড়া জাতীয় পার্টি, জাসদ, ইসলামিক ফ্রন্ট ও সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের প্রার্থীরা তাদের মনোনয়ন ফরম জমা দেন।
নোয়াখালী- ৬ (হাতিয়া) আসনে মোট প্রার্থী ৬ জন। এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী আয়শা ফেরদৌস এমপিও মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এছাড়া জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও এনপিপির প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে আচরণবিধি মেনে প্রার্থীরা মনোনয়ন ফরম দাখিল করেছেন। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মনোনয়ন ফরম দাখিলের শেষ দিনে ৬টি আসনে ১৬টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী এবং ১৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে মোট ৫৫টি মনোনয়ন ফরম জমা নেওয়া হয়েছে। আমরা সবাইকে আইন মেনে সব কাজ সম্পন্ন করতে অনুরোধ করব। মানুষ যেনো নির্বিঘ্নে উৎসবমুখর পরিবেশে যেনো ভোট দিতে পারে সেজন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বিকভাবে কাজ করবে।
উল্লেখ্য, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর, মনোনয়ন ফরম যাচাই-বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল ও নিষ্পত্তি ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর এবং নির্বাচনী প্রচারণা ১৮ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির ৫ তারিখ পর্যন্ত চলবে বলে জানায় ইসি।