দেশে মাদক কারবারে জড়িত ৬৬ হাজার ১৮ জন। তাদের কেউ মাদকের কারবারি, কেউবা পৃষ্ঠপোষক। নিষিদ্ধ এই কারবারে জড়িত ব্যক্তিরা বছরে পাচার করছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এসব ব্যক্তির তালিকা ধরে সমন্বিত অভিযানের পরিকল্পনা করছে সরকার। গ্রেপ্তারের পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হবে তাদের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। মাদক নির্মূল করতে প্রয়োজনে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে।
গত জুনে আঙ্কটাডের (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) ওয়েবসাইটে অবৈধ অর্থপ্রবাহ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মাদক কেনাবেচার অর্থ পাচারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম আর এশিয়ায় শীর্ষে। মাদকের কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হয় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।
ওই তথ্য প্রকাশের পর হাইকোর্ট অভিযোগটি অনুসন্ধান করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতি এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী টাকা পাচারকারী মাদক কারবারিদের তালিকা করে মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সংস্থাগুলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ, ৩০তম বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে তালিকাভুক্ত এই মাদক কারবারিদের ‘মাদক মাফিয়া’ আখ্যায়িত করা হয়।
সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা নিয়মিত হালনাগাদ করছে। পাশাপাশি মাদক কারবারে অর্থলগ্নিকারী ও পৃষ্ঠপোষকদেরও তালিকা করা হচ্ছে। মাদক কারবারের মাধ্যমে অর্থ পাচারকারীদের তালিকা করতে গত ১৯ জুলাই মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি কমিটিকে জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে মাদক কারবারি ও মাদকের অর্থ পাচারকারী ৬৬ হাজার ১৮ জনের তালিকা রয়েছে।
সংস্থাটির নিজস্ব তালিকায় মাদক কারবারির সংখ্যা ১৭ হাজার ৬০৩ জন। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তালিকায় ১১ হাজার ১৭৬ জন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তালিকায় ৩ হাজার ৮৯২ জন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) তালিকায় ৫ হাজার ৯১, র্যাবের তালিকায় ৩ হাজার ২৫, কোস্ট গার্ডের তালিকায় ২ হাজার ৩১ এবং বাংলাদেশ পুলিশের তালিকায় ২৫ হাজার জন রয়েছে। এরাই মাদক কারবার করছে। এই কারবার থেকে পাওয়া অর্থ পাচার করছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনার কপি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে পৌঁছে গেছে। দুই মাস সময় দেওয়া হলেও এখনো কোনো সংস্থা প্রতিবেদন দেয়নি।
এদিকে মাদক কারবারি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটি। কমিটির অভিযোগ, আলাদা আলাদা তালিকা করতে গিয়ে আসল কারবারিদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে তথ্যের ভুলে সাধারণ মানুষের নামও এই তালিকায় ঢুকে গেছে। কমিটির সদস্যদের ধারণা, সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এমন হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মামলার তদন্তের দুর্বলতার কারণে মাদক কারবারের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মূলত মাদকসহ যারা ধরা পড়ে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু মাদকের উৎস, গন্তব্য এবং মূল কারবারিরা আড়ালেই থেকে যায়।
জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, পৃষ্ঠপোষকদের না ধরতে পারলে মাদক কারবার বন্ধ করা কঠিন। হাজার হাজার কোটি টাকার এই কারবার চুনোপুঁটি দিয়ে হয় না। পেছনে থাকে রাঘববোয়াল। তাদের তালিকাভুক্ত করে আইনের আওতায় আনা দরকার। তালিকা করাই সমাধান নয়।