পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজার। মানুষ ক্লান্তি মেটাতে অবসর সময়টুকু হাতে নিয়ে এই সমুদ্র সৈকতের পর্যটন নগরীতে আসেন খনিকের জন্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সড়ক ও বিমান পথের মাধ্যমে কক্সবাজারে এতোদিন আসা গেলেও নতুন একটি আরামদায়ক ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা যুক্ত হচ্ছে আজ।
প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় সাড়ে ১৩ বছর পর বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের ৪৮তম জেলা হিসেবে যুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার। ফলে মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সড়ক ও বিমান পথের পাশাপাশি এখন থেকে রেলপথেও আসতে পারবেন। ‘কু ঝিকঝিক’ শব্দে ট্রেন যাবে সাগর পাড়ে।
শনিবার (১১ নভেম্বর) সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধন করবেন।
আর এর মধ্য দিয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হবে কক্সবাজার, তথা যুক্ত হবে ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে। রেলপথটি বাংলাদেশকে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত করবে। ২০৪৫ সালের মধ্যে দেশের ৬০টি জেলায় রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের লক্ষ্য আছে বাংলাদেশে রেলওয়ের।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মায়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য ২০১০ সালে ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। মেগা প্রকল্প হিসেবে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
পরবর্তীতে টেন্ডার হলে দোহাজারি-চকরিয়া এবং চকরিয়া-কক্সবাজার (লট-১ ও লট-২) এই দুই লটে চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরসি (চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন) ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান তমা কনসট্রাকশন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ পায়। কার্যাদেশ দেওয়ার পর ২০১৮ সালে এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সেই হিসেবে আজ পর্যন্ত অনুমোদানের ১৩ বছর ৪ মাস ৪ দিন পর প্রকল্পটির উদ্বোধন হচ্ছে। এই ১০২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
এ বছর আগস্টের মাঝামাঝিতে হওয়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকল্পের আধা কিলোমিটারের মতো রেলপথ।
আগে রেলওয়ে নেটওয়ার্কে ৪৪টি জেলা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও গত ১ নভেম্বর খুলনা-মোংলা রেলপথ উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে ৪৭টি জেলায় রেল সংযোগ হয়েছে। শনিবার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ৪৮তম জেলা হিসেবে রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে কক্সবাজার।রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন
জানা যায়, প্রকল্পের সাতকানিয়ার তেমুহনী এলাকায় রেলপথটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত অংশে আধা কিলোমিটারের মতো রেলপথের কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু হয়ে যায়। পাথর সরে যায় স্লিপারের মাঝ থেকে। সৃষ্টি হয় হাঁটু থেকে বুক সমান অসংখ্য বড় বড় গর্ত। পরে ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ দুই সপ্তাহের মধ্যে সংস্কার করা হয়।
রেলপথের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে কালুঘাট সেতু, দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল সম্পন্ন হয়েছে। গত ৫ নভেম্বর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে পরীক্ষামূলক ট্রেনটি রওনা হয়ে সন্ধ্যা ৬টা ২৪ মিনিটের দিকে কক্সবাজারে পৌঁছায়।
অবশেষে আজ উদ্বোধন হচ্ছে এই রেলপথ। এই পথে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হবে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে। তবে ভাড়া নির্ধারণ হলেও এখনও ঠিক হয়নি ট্রেনের সময়সূচি।
প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হয়েছে। মোট ১০২ কিলোমিটার রেলপথে স্টেশন থাকছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে— সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার সাহারবিল, ডুলাহাজারা, ঈদগাও, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও ঘুমধুম।
এতে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম থাকবে ৯টি, ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম থাকবে ৯টি। এদিকে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বড় সেতু। এ ছাড়া ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট, সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় একটি ফ্লাইওভার, ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং এবং রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং রয়েছে। এছাড়াও চুনতি এলাকায় একটি আন্ডারপাসের ওপর দিয়ে হাতি চলাচলের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর এই প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হচ্ছে আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর এই স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয় তলা বিশিষ্ট ভবনটির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। কাজ শেষের পর থেকে আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছে অসংখ্যক মানুষ। এই স্টেশনেই হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
আইকনিক রেলস্টেশন প্রসঙ্গে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার আবদুল জাবের মিলন বলেন, ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এই দৃষ্টিনন্দন স্টেশন। আইকনিক স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছেন। চার বছরের শ্রমে অনন্য সুন্দর রেলস্টেশন ভবনটি আজ দৃশ্যমান।
তিনি বলেন, এই স্টেশনটি হবে এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা স্টেশন। এতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এ ছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকেট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, লকারসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিন তলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল। থাকছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। এছাড়া থাকবে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানা সেবা কেন্দ্র।
প্রকল্প প্রসঙ্গে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন জানান, দোহাজারী-কক্সবাজার নতুন রেলপথ প্রকল্প শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। এজন্য সব ধরণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে ১০২ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হয়েছে। কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশনসহ নয়টি স্টেশনের নির্মাণ কাজ শেষ। এছাড়াও চুনতি এলাকায় একটি আন্ডারপাসের ওপর দিয়ে হাতি চলাচলের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পথে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ট্রেন চলাচলের সময় এখনও চুড়ান্ত হয়নি। কিন্তু এর আগেই নতুন রুটে ভাড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন শহর কক্সবাজারে ট্রেনে করে যেতে লাগবে সর্বনিম্ন ৫৫ টাকা আর সর্বোচ্চ ৬৯৬ টাকা। শোভন চেয়ারে (নন-এসি) বসে যেতে দিতে হবে ২০৫ টাকা। নতুন নির্মিত এই রেললাইনে ট্রেনের ভাড়া বাসের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্রে জানান গেছে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শোভন চেয়ারের ভাড়া ২২০টা, প্রথম শ্রেণীর চেয়ারের ভাড়া ৩৩৪ টাকা, এসি চেয়ারের ভাড়া ৪১৪ টাকা, প্রথম শ্রেণীর বার্থের ভাড়া ৫০১ টাকা, এসি সিটের ভাড়া ৫০১ টাকা এবং এসি বার্থের ভাড়া ৭৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শোভন চেয়ারের ভাড়া ৫৬৫টা, প্রথম শ্রেণীর চেয়ারের ভাড়া ৮৬৩ টাকা, এসি চেয়ারের ভাড়া ৯১৫ টাকা, প্রথম শ্রেণীর বার্থের ভাড়া এক হাজার ২৫৯ টাকা, এসি সিটের ভাড়া এক হাজার ২৫৯ টাকা এবং এসি বার্থের ভাড়া এক হাজার ৯৭৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, আমাদের সবার জন্য গর্বের একটা বিষয় কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন বিল্ডিং। এরকম অনন্য স্থাপনা অন্য কোথাও নেই। ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সমুদ্র সৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। ১ ডিসেম্বর থেকে এক জোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন ঢাকা থেকে চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আর চট্টগ্রাম থেকে এক জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলবে।
রেলপথ মন্ত্রী বলেন, আগে রেলওয়ে নেটওয়ার্কে ৪৪টি জেলা অন্তর্ভুক্ত থাকলেও গত ১ নভেম্বর খুলনা-মোংলা রেলপথ উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে ৪৭টি জেলায় রেল সংযোগ হয়েছে। শনিবার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ৪৮তম জেলা হিসেবে রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে কক্সবাজার।
তিনি বলেন, ১৬ জেলায় এখনও কোনো রেল সংযোগ গড়ে ওঠেনি। এগুলোর মধ্যে মাগুরা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, শেরপুর, মানিকগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর জেলাগুলোকে ২০৪৫ সালের মধ্যে রেলপথের আওতায় আনতে চায় সরকার। বর্তমানে যেসব প্রকল্পের সমীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে সেই প্রকল্পগুলোর আওতায় রেলপথ নির্মিত হলে সাতক্ষীরা, বরিশাল, রাঙ্গামাটি, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও মেহেরপুর এই ৮টি জেলা রেলওয়ে সংযোগের আওতায় চলে আসবে।
রেলপথ মন্ত্রী আরও বলেন, মানিকগঞ্জ জেলায়ও রেলপথ নির্মাণের সমীক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান মাস্টারপ্ল্যান সম্পন্ন হলে বাকি ৪ জেলা লক্ষ্মীপুর, শেরপুর, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি ২০৪৫ সালের মধ্যে রেল সংযোগের আওতায় আসবে। তখন দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলা ছাড়া বাকি সব জেলা যুক্ত হবে রেল নেটওয়ার্কে।