ঘড়ির কাঁটা যখন সন্ধ্যা ৬ টা ছুঁই ছুঁই। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তখন মানুষের কোলাহল এবং শিক্ষার্থীরা আনাগোনা বেড়ে যায়। ঠিক সে সময়ে একটা চায়ের ফ্লাস্ক এবং কয়েকটি চায়ের কাপ নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল ফটকের সামনে বসে থাকেন এক তরুণ শিক্ষার্থী। সেই অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন ক্রেতা সন্ধানের খোঁজে।
বলছি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী শাকিল মিয়ার কথা। স্বাধীনচেতা শাকিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের থেকে একটু ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী। তিনি আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্লাসের সহপাঠী, সিনিয়র এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। নিজের খরচ সামাল দিতে সন্ধ্যা হলে বেড়িয়ে পড়েন চা বিক্রি করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শত বাঁধা থাকার সত্ত্বেও শাকিল চা বিক্রি করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
পরিবারের বড় ছেলে শাকিল। তার উপর রয়েছে অনেক দায়িত্ব। সেই কলেজ জীবন শেষ করে সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পা রাখেন। তার স্বপ্ন হলো একজন সফল উদ্যোক্তা হবে। দীর্ঘদিনের ইচ্ছে পূরণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে সন্ধ্যা চা বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট এবং প্রেজেন্টেশনের ব্যস্ততার মাঝেও সেই সামলে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের ব্যবসাটি। তার এই কাজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও তার সহপাঠীরা ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
শাকিল মাধ্যমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন নিজ গ্রামের দড়িপুরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন জয়নগর ডিগ্রি কলেজ থেকে। প্রথমবারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় দিয়েও ভর্তির সুযোগ মেলে নাই শাকিলের। তবুও সেই দমে যায় নিয়৷ রবার্ট ব্রুসের মতো হার না মানা এই শাকিল পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। এবার অসম্ভবকে সম্ভব করে ভর্তি হয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি নিজের খরচ মেটাতে মাদ্রাসার শিক্ষকতা ও টিউশন করতেন।
শাকিল বাবার কৃষি কাজের পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরার জন্য একসময় টিউশন করতেন। কিন্তু কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর টিউশনি ও আয়ের তেমন সুযোগ সুবিধা না থাকায় ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়েছেন। আবেগ আপ্লুত হয়ে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে শাকিল বলেন, কোনো কাজ ছোট নয়, যদি তা সৎ পথে হয়। এই বাণী ধারণ করে জীবনের প্রতিটা ধাপে আমি চলতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু -বান্ধব সবাই আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করছে। তবে আর কিছু পুঁজি থাকলে একটা চায়ের স্টল দিব। প্রথমে চায়ের ফ্লাস্ক দিয়ে শুরু করেছি সেটা সামনে আরও এগিয়ে যেতে চাই।’
এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী কাউছার বলেন, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীকে কে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে দেখতে পেয়ে নিজেকে গর্ববোধ করছি । হয়ত আমরা সবাই একদিন ভালো কিছু করবো। তবে নিজের চোখে সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর এমন সফলতা দেখা সত্যিই আনন্দের বিষয়। শাকিলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করছি এবং আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সাহায্য করার চেষ্টা করব।’
শুধুমাত্র শাকিল না, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারো শাকিল রয়েছে যারা নিজের পড়াশোনার খরচ মেটাতে চড়িয়ে বেড়ান এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। ক্লাসের ব্যস্ততার মাঝেও সারাদিন টিউশনি করে আবার নিজেকে গড়ে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এই শাকিলরা। তারাই আগামীর ভবিষ্যৎ, এই শাকিলরা একদিন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।