দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতি যাচাই করতে শনিবার (৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের সাত সদস্যের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ৭ রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ছাড়াও সরকারি সংস্থা, বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংস্থার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক মার্কিন দলটি।
এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসেছে দলটি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) প্রতিনিধি দলটি শনিবার থেকে সোমবার (১৩ অক্টোবর) ঢাকায় অবস্থান করবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের করের টাকা ব্যয় করে কোনো টিমকে নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে পাঠানোর মানেই হলো এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সে দেশের সরকার।
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন, মারিয়া চিন আব্দুল্লা, মারিও মাইত্রি, জেমি ক্যানডেন্স সাক্স স্পাইকারম্যান, আকাশ সিসাসাই কুলোরি, ডেনিয়েল মাইকেল রেইলি, জিওফ্রে পিটার ম্যাকডোনাল্ট।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য এনডিআইয়ের নীতিমালার ঘোষণা অনুযায়ী, একটি যৌথ প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন (পিইএএম) পরিচালনা করতে তারা এসেছেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পরিষ্কার করে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। সবকিছু মিলে বাংলাদেশের প্রাক-নির্বাচনী পরিবেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের উপযোগী কিনা সেটাই উঠে আসবে তাদের প্রতিবেদনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ কতখানি আছে সেটাই তারা এসেস করার চেষ্টা করছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। শেষ দুটি নির্বাচন তারা পর্যবেক্ষণ করেনি। এবার করবে কিনা বা মার্কিন সরকার নির্বাচনকে এনডোর্স করবে কিনা- সেটি নির্ভর করবে এ টিমের সুপারিশের ভিত্তিতেই। তাদের মতে, গত প্রায় দুথবছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক:-
পর্যবেক্ষক দলটি সবার প্রথমে বৈঠক করেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলকে বলা হয়েছে, বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধানসম্মত কোনো প্রস্তাব দেওয়া হলে ক্ষমতাসীন দলটি সমঝোতা করতে রাজি আছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে সমঝোতা নয়।
দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার কোনো জায়গা নেই। বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়েছে বিএনপি সমঝোতা-আপসের কোনো পথ খোলা রাখেনি। বিএনপির দাবি সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে তো আওয়ামী লীগ সমঝোতা করবে না।
বৈঠকে নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচনী পরিবেশ, প্রশাসনের ভূমিকা, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা ও সাজা দেওয়া, রাজনৈতিক সুযোগ, সবার জন্য সমান সুযোগের সম্ভাবনা ও বিএনপির তোলা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানতে চায় মার্কিন প্রতিনিধিদল। এসব বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার পাশাপাশি আইনি যুক্তি তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
এদিকে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক হয় দলটির। এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, মার্কিন প্রতিনিধিদলটির আলোচনায় ঘুরেফিরে কথা একটাই এসেছে। তা হলো বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কি না। আর হতে হলে কী কী প্রয়োজন? কীভাবে করা যায়? তিনি বলেন, বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানের বিশ্বাসযোগ্য অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন হতে হবে। এর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো ব্যবধান নেই বলে বিএনপি মনে করে।
জাতীয় পার্টির সঙ্গে গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে বৈঠক করেছে পর্যবেক্ষক দলটি। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের জানান, বৈঠকে প্রতিনিধিদলটি আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা যায়, আলোচনায় সে বিষয়ের জোর দিয়েছে। এ ছাড়া এর আগে এখানে নির্বাচনে কী ধরনের অসুবিধা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তারা নানা প্রশ্ন করেছে।
ঢাকার একটি হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশনের সাথে আমার বাংলাদেশ পার্টি এবি পার্টিসহ আরও ৪ টি দলের সঙ্গে বৈঠক করে।
এবি পার্টির পক্ষ থেকে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে মতামত ও মূল্যায়ন তুলে ধরেন দলের যুগ্ম সদস্যসচিব ও কূটনৈতিক টিমের প্রধান ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তিনি বলেন, আজ এটা সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক:-
আগামী সংসদ নির্বাচন বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রতিনিধিরা। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে পুরো কমিশন উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, আজকের বৈঠকে আমেরিকার প্রি-অ্যাসেসমেন্ট টিম আমাদের রোল, দায়িত্ব, কর্মকাণ্ড, সরকারের সঙ্গে ইসির কো-অর্ডিনেশন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমরা তাদের আমাদের পক্ষ থেকে ইসির রোল, সরকারের রোল, সরকারের সঙ্গে ইসির কো-অর্ডিনেশন সবকিছু সম্পর্কে জানিয়েছি।
বুধবার (১১ অক্টোবর) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক:-
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মার্কিন দল তার কাছে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে যে- সরকার ঠিকমতো নির্বাচন করতে পারবে কিনা ও সেই সক্ষমতা আছে কিনা। আর বিরোধী দল নির্বাচনে আসলে ঠিকমতো প্রচারের সুযোগ পাবে কিনা।
তারা জানতে চেয়েছে- প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীন বোধ করলে কিংবা কোনো দল যদি মনে করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে তখন সরকার কি করবে? জবাবে আমরা বলেছি, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা আগে হতো, এখন আর এগুলো হয় না। আর আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সুন্দর নির্বাচনের জন্য তৈরি হয়ে আছে। তপশিল ঘোষণার পরে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে তারা, সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে বলছিলেন তিনি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বর্তমান সরকার অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সাথে।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইনের কি পার্থক্য আছে তা জানতে চায় প্রতিনিধি দল। নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে, এজন্য যা যা করার দরকার সরকার সেটা করছে বলে প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হবে কিনা, এ বিষয়ে মার্কিন প্রতিনিধি দল কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। কারো নির্বাচনে আসা না আসা তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
সর্বশেষ বুধবার (১১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ:-
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি এবং গণতন্ত্র অর্জন করেছি। আমরা গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বৈঠকে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বদানকারী ইউএসএআইডির সাবেক ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বনি গ্লিক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিনিধিদলটি কূটনীতিকসহ সব অংশীজনের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের লক্ষ্য হল সব অংশীজনের কথা শোনা। তারা মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন না, তারা ব্যক্তিগত ক্ষমতাবলে এখানে এসেছে।
প্রতিনিধিদলের সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল এফ ইন্ডারফার্থ বলেন, গণতন্ত্রের কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা আছে এবং এমনকি সমস্যাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে। ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
এর বাইরে সিভিল সোসাইটি, নারী প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধিসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনার সময় মূলত নির্বাচনে সহিংসতার সম্ভাবনা কতটা, সবার জন্য সঠিক পরিবেশ আছে কিনা- মূলত এগুলোই ছিল মার্কিন দলটির মূল জিজ্ঞাসা।